, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
সংবাদের বিষয়ে কিছু জানাতে ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের ৫৪তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় ০৮:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫
  • / ১৭ বার পড়া হয়েছে

আজ ২৮ অক্টোবর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের ৫৪তম শাহাদাতের বার্ষিকী। এ দিনটি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে সেই সাহসী বীরকে, যিনি জীবন উৎসর্গ করে মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছিলেন। তাঁর সাহস, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার খোর্দ খালিশপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। পারিবারিক আর্থিক পরিস্থিতির কারণে বড় ভাই হিসেবে ছোটবেলা থেকেই কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হতো তাঁকে। কিশোর বয়সে তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। গ্রামের খেলাধুলায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। তবে অভাব-অনটনের মধ্যেই কৈশোর শেষ না করেই পিতার ইচ্ছানুযায়ী তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য মুজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হন। একদিন যশোরের চৌগাছার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মহড়া দেখে তাঁর মনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ জন্মে। এই আগ্রহ থেকেই ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যশোরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং টিম আসলে তিনি সৈনিক হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান। রিক্রুটিং টিমের প্রশিক্ষণে সুস্বাস্থ্যের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রামের আইবিআরসিতে যোগ দেন। সাধারণ রিক্রুটদের এই প্রশিক্ষণ সাধারণত ৬ মাসের হলেও দেশের পরিস্থিতির কারণে কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনে বড় পরিবর্তন ঘটে। ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ইবিআরসির রিক্রুটদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। এই গোলাগুলির মধ্যে তিনি ও কিছু রিক্রুট পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পরে সুযোগ বুঝে তারা প্রথমে বাড়ি যান, এরপর যশোরের চৌগাছায় থাকা ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর তাঁকে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নিয়মিত সৈনিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাঁর সৈনিক নম্বর ছিল ৩৯৪৩০১৪। পরবর্তীতে তাঁর অসীম সাহস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্মপ্রেরণায় তাঁকে কোম্পানি কমান্ডারের রানার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যুদ্ধের সময় একজন রানার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কমান্ডারের প্রতিটি আদেশ সঠিকভাবে অন্যদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব তাঁর। সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের শেষ যুদ্ধ ছিল ঐতিহাসিক ধলই যুদ্ধ।

সিলেটের (পরবর্তীতে মৌলভীবাজারের) শ্রীমঙ্গল থানার ধলই গ্রাম থেকে প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সীমান্তের প্রায় ৪০০ গজ দূরে ধলই চা-বাগানের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ধলই বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি)। এই বিওপি দখলের জন্য ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এই কোম্পানির একজন সাহসী সৈনিক ছিলেন সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ধলই এলাকায় ৩০ এফএফ ও এক কোম্পানি রাজাকাররা অবস্থান নেন। ধলই বিওপির শত্রু অবস্থান এতই শক্তিশালী ছিল যে, সেখানে অটোমেটিক অস্ত্রগুলো ছিল কংক্রিটের বাঙ্কারে, যা মাঝারি আর্মার গোলা থেকেও নিরাপদ ছিল। শত্রুরা পাঁজি ও মাইন বসিয়েছিল। এই অবস্থানকে সুরক্ষিত রাখতে ধলই ভ্যালি ক্লাবে একটি আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন ছিল। ২৮ অক্টোবর ভোরের দিকে মূল আক্রমণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের নেতৃত্বে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয় দল। আর্টিলারি ফায়ারের পেছনে ৭ নং প্ল্যাটুন ডানদিকে, ৯ নং প্ল্যাটুন বামদিকে, নায়েব সুবেদার আবুল হাশেম ও সুবেদার সাত্তার নেতৃত্বে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাধা অতিক্রম করে তাঁরা শত্রু অবস্থানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আঘাত করে, ফলে ‘সি’ কোম্পানি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন হেডকোয়ার্টার থেকে বার্তা আসে যে, সব কিছুকে উপেক্ষা করে ধলই দখল করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা আবারও অগ্রসর হন, কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর এলএমজি গুলির আওয়াজে তাঁদের অগ্রগতি থামে। কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তাঁর দিক নির্দেশে বলেন, এই এলএমজি বন্ধ করতে হবে। এতে সাহস জোগাতে এক মুহূর্ত দেরি না করে সিপাহি হামিদুর রহমান ক্রলিং করে এগিয়ে যান এলএমজির দিকে। তিনি কাঁচা রাস্তা দিয়ে ভারতের দিকে যান, পাশাপাশি চা-বাগানের সেচের খালের ভেতর দিয়ে এলএমজি পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছান। তখন শত্রুরা তাঁকে দেখে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এই সময় তিনি দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে মারমুখী সংঘর্ষে লিপ্ত হন। যুদ্ধের মধ্যে তিনি শত্রুদের ঘায়েল করেন এবং নিজেও গুরুতর আহত হন। তারপরও তিনি শত্রুর এলএমজি বাঙ্কারে গ্রেনেড ছুড়েন, শত্রুর এলএমজি ম্যানকে নিষ্ক্রিয় করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ধলই সীমান্ত ঘাঁটিতে প্রবেশ করেন। ওই পোস্টের পাশে তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, পাশে ছিল দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের মৃতদেহ। তাঁর বীরত্বের ফলে ধলই বাগানের কিছু অংশ এবং পত্রখোলা চা-বাগানের কিছু অংশ মুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তাঁর দল নিয়ে আরও সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ধলই যুদ্ধ ৭ দিন অব্যাহত থাকে। দীর্ঘ লড়াই শেষে অবশেষে ৩ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ধলই বিওপি দখল করতে সক্ষম হন। এই বিজয়ে শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমানের অবদান চিরস্মরণীয়। নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি সহযোদ্ধাদের অগ্রসর করার পথ সুগম করেছিলেন। তাঁর আত্মত্যাগের জন্য পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। সেই দিন তাঁর মরদেহ ভারতের আম্বাসা গ্রামে দাফন করা হয়। অনেক বছর পরে, বিভিন্ন ব্যক্তির প্রচেষ্টায়, ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারত থেকে তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয় এবং পুনরায় দাফন করা হয়। দেশের জন্য তাঁর নিঃস্বার্থ দায়িত্ববোধের অনন্য উদাহরণ তিনি স্থাপন করেছেন, যা তাঁকে একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে চির স্মরণীয় করে রাখে। সিপাহী হামিদুর রহমানের নাম আজও অনুপ্রেরণার উৎস।


প্রিন্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের ৫৪তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ

আপডেট সময় ০৮:৩২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫

আজ ২৮ অক্টোবর, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের ৫৪তম শাহাদাতের বার্ষিকী। এ দিনটি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে সেই সাহসী বীরকে, যিনি জীবন উৎসর্গ করে মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছিলেন। তাঁর সাহস, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানার খোর্দ খালিশপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড়। পারিবারিক আর্থিক পরিস্থিতির কারণে বড় ভাই হিসেবে ছোটবেলা থেকেই কিছু অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হতো তাঁকে। কিশোর বয়সে তিনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। গ্রামের খেলাধুলায় তাঁর বেশ সুনাম ছিল। তবে অভাব-অনটনের মধ্যেই কৈশোর শেষ না করেই পিতার ইচ্ছানুযায়ী তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য মুজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হন। একদিন যশোরের চৌগাছার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মহড়া দেখে তাঁর মনে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ জন্মে। এই আগ্রহ থেকেই ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে যশোরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং টিম আসলে তিনি সৈনিক হওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ান। রিক্রুটিং টিমের প্রশিক্ষণে সুস্বাস্থ্যের জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয়। ১৯৭১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তিনি চট্টগ্রামের আইবিআরসিতে যোগ দেন। সাধারণ রিক্রুটদের এই প্রশিক্ষণ সাধারণত ৬ মাসের হলেও দেশের পরিস্থিতির কারণে কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর জীবনে বড় পরিবর্তন ঘটে। ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা ইবিআরসির রিক্রুটদের নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। এই গোলাগুলির মধ্যে তিনি ও কিছু রিক্রুট পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পরে সুযোগ বুঝে তারা প্রথমে বাড়ি যান, এরপর যশোরের চৌগাছায় থাকা ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রবল আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর তাঁকে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নিয়মিত সৈনিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাঁর সৈনিক নম্বর ছিল ৩৯৪৩০১৪। পরবর্তীতে তাঁর অসীম সাহস, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্মপ্রেরণায় তাঁকে কোম্পানি কমান্ডারের রানার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যুদ্ধের সময় একজন রানার খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কমান্ডারের প্রতিটি আদেশ সঠিকভাবে অন্যদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্ব তাঁর। সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমানের শেষ যুদ্ধ ছিল ঐতিহাসিক ধলই যুদ্ধ।

সিলেটের (পরবর্তীতে মৌলভীবাজারের) শ্রীমঙ্গল থানার ধলই গ্রাম থেকে প্রায় ১০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সীমান্তের প্রায় ৪০০ গজ দূরে ধলই চা-বাগানের পূর্ব প্রান্তে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ধলই বর্ডার আউটপোস্ট (বিওপি)। এই বিওপি দখলের জন্য ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘সি’ কোম্পানি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়। এই কোম্পানির একজন সাহসী সৈনিক ছিলেন সিপাহি মোহাম্মদ হামিদুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ধলই এলাকায় ৩০ এফএফ ও এক কোম্পানি রাজাকাররা অবস্থান নেন। ধলই বিওপির শত্রু অবস্থান এতই শক্তিশালী ছিল যে, সেখানে অটোমেটিক অস্ত্রগুলো ছিল কংক্রিটের বাঙ্কারে, যা মাঝারি আর্মার গোলা থেকেও নিরাপদ ছিল। শত্রুরা পাঁজি ও মাইন বসিয়েছিল। এই অবস্থানকে সুরক্ষিত রাখতে ধলই ভ্যালি ক্লাবে একটি আর্টিলারি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন ছিল। ২৮ অক্টোবর ভোরের দিকে মূল আক্রমণ শুরু হয়। ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের নেতৃত্বে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয় দল। আর্টিলারি ফায়ারের পেছনে ৭ নং প্ল্যাটুন ডানদিকে, ৯ নং প্ল্যাটুন বামদিকে, নায়েব সুবেদার আবুল হাশেম ও সুবেদার সাত্তার নেতৃত্বে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। বাধা অতিক্রম করে তাঁরা শত্রু অবস্থানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর পাল্টা আঘাত করে, ফলে ‘সি’ কোম্পানি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন হেডকোয়ার্টার থেকে বার্তা আসে যে, সব কিছুকে উপেক্ষা করে ধলই দখল করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা আবারও অগ্রসর হন, কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পর এলএমজি গুলির আওয়াজে তাঁদের অগ্রগতি থামে। কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তাঁর দিক নির্দেশে বলেন, এই এলএমজি বন্ধ করতে হবে। এতে সাহস জোগাতে এক মুহূর্ত দেরি না করে সিপাহি হামিদুর রহমান ক্রলিং করে এগিয়ে যান এলএমজির দিকে। তিনি কাঁচা রাস্তা দিয়ে ভারতের দিকে যান, পাশাপাশি চা-বাগানের সেচের খালের ভেতর দিয়ে এলএমজি পোস্টের কাছাকাছি পৌঁছান। তখন শত্রুরা তাঁকে দেখে ফেলে। কিন্তু ততক্ষণে তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এই সময় তিনি দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে মারমুখী সংঘর্ষে লিপ্ত হন। যুদ্ধের মধ্যে তিনি শত্রুদের ঘায়েল করেন এবং নিজেও গুরুতর আহত হন। তারপরও তিনি শত্রুর এলএমজি বাঙ্কারে গ্রেনেড ছুড়েন, শত্রুর এলএমজি ম্যানকে নিষ্ক্রিয় করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত ধলই সীমান্ত ঘাঁটিতে প্রবেশ করেন। ওই পোস্টের পাশে তাঁর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়, পাশে ছিল দুজন পাকিস্তানি সৈন্যের মৃতদেহ। তাঁর বীরত্বের ফলে ধলই বাগানের কিছু অংশ এবং পত্রখোলা চা-বাগানের কিছু অংশ মুক্ত হয়। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম তাঁর দল নিয়ে আরও সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ধলই যুদ্ধ ৭ দিন অব্যাহত থাকে। দীর্ঘ লড়াই শেষে অবশেষে ৩ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা ধলই বিওপি দখল করতে সক্ষম হন। এই বিজয়ে শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমানের অবদান চিরস্মরণীয়। নিজের জীবন বিপন্ন করে তিনি সহযোদ্ধাদের অগ্রসর করার পথ সুগম করেছিলেন। তাঁর আত্মত্যাগের জন্য পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। সেই দিন তাঁর মরদেহ ভারতের আম্বাসা গ্রামে দাফন করা হয়। অনেক বছর পরে, বিভিন্ন ব্যক্তির প্রচেষ্টায়, ২০০৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারত থেকে তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয় এবং পুনরায় দাফন করা হয়। দেশের জন্য তাঁর নিঃস্বার্থ দায়িত্ববোধের অনন্য উদাহরণ তিনি স্থাপন করেছেন, যা তাঁকে একজন দেশপ্রেমিক সৈনিক হিসেবে চির স্মরণীয় করে রাখে। সিপাহী হামিদুর রহমানের নাম আজও অনুপ্রেরণার উৎস।


প্রিন্ট