, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
সংবাদের বিষয়ে কিছু জানাতে ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়

দুই বীর সেনার মৃত্যুতে স্তব্ধ কুড়িগ্রাম, পরিবারে আহাজারি

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় ০৮:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
  • / ১১ বার পড়া হয়েছে

সুদানের আবেই অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলায় নিহত হয়েছেন বাংলাদেশের ছয় শান্তিরক্ষী। এর মধ্যে দুইজনের বাড়ি কুড়িগ্রামে। দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী এই দুই বীর সেনাকে হারিয়ে পুরো কুড়িগ্রাম শোকের আগুনে জ্বলছে। পরিবার, স্বজন ও গ্রামবাসী কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। নিহত দুই সেনাসদস্যের বাড়িতে গিয়ে এই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখা গেছে। এর আগে শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা আকস্মিক হামলা চালায়। হামলার সময় ঘাঁটির অভ্যন্তর ও আশেপাশের এলাকায় তুমুল গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে বাংলাদেশের ছয় শান্তিরক্ষী শহীদ হন এবং অন্তত আটজন আহত হন। সেনাবাহিনীর ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক পোস্টে বলা হয়, শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ৪০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে কাদুগলি লজিস্টিক বেসে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালায়। এই হামলায় দায়িত্ব পালনরত ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হন। সেনাবাহিনীর প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী শহীদরা হলেন— কর্পোরাল মো. মাসুদ রানা, এএসসি (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম, বীর (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা, বীর (রাজবাড়ী), সৈনিক শান্ত মন্ডল, বীর (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)। নিহত শান্তিরক্ষী সৈনিক শান্ত মন্ডল (২৬) কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের সাটমাধাই ডারারপাড় গ্রামের বাসিন্দা। তিনি সাবেক সেনাসদস্য (মৃত) নুর ইসলাম মন্ডলের ছেলে। তার মা সাহেরা বেগম। বড় ভাই সোহাগ মন্ডলও সেনাবাহিনীতে কর্মরত, বর্তমানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ল্যান্স কর্পোরাল পদে আছেন। রোববার দুপুরে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে বাকরুদ্ধ মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে আছেন। বড় ভাই সোহাগ মন্ডলের চোখ লাল হয়ে অঝোর কেঁদে চলেছেন। প্রতিবেশী ও স্বজনরা একের পর এক এসে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সোহাগ মন্ডল জানায়, শান্ত ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। গত ৭ নভেম্বর শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান। তিনি আরও বলেন, ‘গত এক বছর আগে শান্ত বিয়ে করে। তার স্ত্রী বর্তমানে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সন্ধ্যায় শান্ত ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সবাইকে কথা বলছিল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারি ওদের ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। পরে নিশ্চিত হই, শান্ত আর নেই। আমরা এখন তার লাশের অপেক্ষায় আছি। বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করতে চাই।’ মাত্র ৩৩ দিন আগে তিনি মিশনে গিয়েছিলেন। সন্ত্রাসী হামলায় নিহত আরেক শান্তিরক্ষী সৈনিক মমিনুল ইসলাম, বীর (৩৮) কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামের বাসিন্দা। তিনি আব্দুল করিমের ছেলে। তার পরিবারে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই কন্যা রয়েছে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ে মাত্র চার বছর বয়সী। জানানো হয়, মাত্র ৩৩ দিন আগে শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান মমিনুল। শনিবার বিকালে ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সবার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন তিনি। রাতের মধ্যে তার মৃত্যুর খবর পৌঁছায় পরিবারে। মমিনুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকের মাতম চলছে। স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মমিনুলের বাবা আব্দুল করিম কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ভালো মানুষ ছিল। এলাকার সবাই তাকে ভালোবাসত। আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন বলে মনে করি। এখন শুধু তার লাশের অপেক্ষায় আছি।’ এই দুই শহীদ সন্তানের মৃত্যুতে কুড়িগ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে শোক ও বেদনায়। এই শহীদদের স্মরণে পুরো জেলায় নেমে এসেছে গভীর শূন্যতা ও নীরবতা।


প্রিন্ট
ট্যাগস

নিউজটি শেয়ার করুন

দুই বীর সেনার মৃত্যুতে স্তব্ধ কুড়িগ্রাম, পরিবারে আহাজারি

আপডেট সময় ০৮:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫

সুদানের আবেই অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীদের ভয়াবহ হামলায় নিহত হয়েছেন বাংলাদেশের ছয় শান্তিরক্ষী। এর মধ্যে দুইজনের বাড়ি কুড়িগ্রামে। দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গকারী এই দুই বীর সেনাকে হারিয়ে পুরো কুড়িগ্রাম শোকের আগুনে জ্বলছে। পরিবার, স্বজন ও গ্রামবাসী কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। নিহত দুই সেনাসদস্যের বাড়িতে গিয়ে এই দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য দেখা গেছে। এর আগে শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১০টার দিকে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীরা আকস্মিক হামলা চালায়। হামলার সময় ঘাঁটির অভ্যন্তর ও আশেপাশের এলাকায় তুমুল গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে বাংলাদেশের ছয় শান্তিরক্ষী শহীদ হন এবং অন্তত আটজন আহত হন। সেনাবাহিনীর ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক পোস্টে বলা হয়, শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ৪০ থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে কাদুগলি লজিস্টিক বেসে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ড্রোন হামলা চালায়। এই হামলায় দায়িত্ব পালনরত ছয়জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী শহীদ হন। সেনাবাহিনীর প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী শহীদরা হলেন— কর্পোরাল মো. মাসুদ রানা, এএসসি (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম, বীর (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা, বীর (রাজবাড়ী), সৈনিক শান্ত মন্ডল, বীর (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)। নিহত শান্তিরক্ষী সৈনিক শান্ত মন্ডল (২৬) কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার সদর ইউনিয়নের সাটমাধাই ডারারপাড় গ্রামের বাসিন্দা। তিনি সাবেক সেনাসদস্য (মৃত) নুর ইসলাম মন্ডলের ছেলে। তার মা সাহেরা বেগম। বড় ভাই সোহাগ মন্ডলও সেনাবাহিনীতে কর্মরত, বর্তমানে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ল্যান্স কর্পোরাল পদে আছেন। রোববার দুপুরে শান্ত মন্ডলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকে বাকরুদ্ধ মা সাহেরা বেগম বিছানায় বসে আছেন। বড় ভাই সোহাগ মন্ডলের চোখ লাল হয়ে অঝোর কেঁদে চলেছেন। প্রতিবেশী ও স্বজনরা একের পর এক এসে শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সোহাগ মন্ডল জানায়, শান্ত ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। সর্বশেষ তিনি বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। গত ৭ নভেম্বর শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান। তিনি আরও বলেন, ‘গত এক বছর আগে শান্ত বিয়ে করে। তার স্ত্রী বর্তমানে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সন্ধ্যায় শান্ত ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সবাইকে কথা বলছিল। রাত সাড়ে ১০টার দিকে জানতে পারি ওদের ক্যাম্পে হামলা হয়েছে। পরে নিশ্চিত হই, শান্ত আর নেই। আমরা এখন তার লাশের অপেক্ষায় আছি। বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করতে চাই।’ মাত্র ৩৩ দিন আগে তিনি মিশনে গিয়েছিলেন। সন্ত্রাসী হামলায় নিহত আরেক শান্তিরক্ষী সৈনিক মমিনুল ইসলাম, বীর (৩৮) কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের পারুলেরপাড় গ্রামের বাসিন্দা। তিনি আব্দুল করিমের ছেলে। তার পরিবারে বাবা-মা, স্ত্রী ও দুই কন্যা রয়েছে। বড় মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে, ছোট মেয়ে মাত্র চার বছর বয়সী। জানানো হয়, মাত্র ৩৩ দিন আগে শান্তিরক্ষী মিশনে সুদানে যান মমিনুল। শনিবার বিকালে ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের সবার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন তিনি। রাতের মধ্যে তার মৃত্যুর খবর পৌঁছায় পরিবারে। মমিনুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, শোকের মাতম চলছে। স্ত্রী ও মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। প্রতিবেশী ও স্বজনরা তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। মমিনুলের বাবা আব্দুল করিম কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ভালো মানুষ ছিল। এলাকার সবাই তাকে ভালোবাসত। আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন বলে মনে করি। এখন শুধু তার লাশের অপেক্ষায় আছি।’ এই দুই শহীদ সন্তানের মৃত্যুতে কুড়িগ্রামের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে শোক ও বেদনায়। এই শহীদদের স্মরণে পুরো জেলায় নেমে এসেছে গভীর শূন্যতা ও নীরবতা।


প্রিন্ট