, সোমবার, ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
সংবাদের বিষয়ে কিছু জানাতে ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়

চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনে ব্যাপক বৃদ্ধি, শুরু হয়েছে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় ০৭:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
  • / ১৫ বার পড়া হয়েছে

চীন ২০২০ সাল থেকে দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রগুলো সম্প্রসারণ করছে— যার ফলশ্রুতিতে দেশের সামরিক ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি আমেরিকার সঙ্গে নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে চলেছে। সিএনএনের বিশ্লেষণে স্যাটেলাইট চিত্র, মানচিত্র ও সরকারি নথিপত্র যাচাই করে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বা চীনা সেনাবাহিনীর রকেট বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত ১৩৬টি স্থাপনার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশে নতুন ধরণের কাজ চলছে। এ সব স্থাপনা—যার মধ্যে কারখানা, গবেষণাগার ও পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে—২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত মোট ২১ লাখ বর্গমিটার নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। উপগ্রহচিত্রে এসব এলাকায় নতুন টাওয়ার, বাঙ্কার, অস্ত্র সংরক্ষণস্থল ও ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশও দেখা গেছে। ন্যাটোর সাবেক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রধান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফোরামের জ্যেষ্ঠ ফেলো উইলিয়াম আলবার জানান, ‘চীন এখন নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। আমরা এক নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার দ্বারপ্রান্তে। চীন ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে এবং দীর্ঘকাল ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকটি উৎপাদন কেন্দ্র এত দ্রুত গড়ে উঠছে যে আশপাশের গ্রাম ও কৃষিজমি দখল করে নিয়েছে। অনেক স্থাপনা গত পাঁচ বছরে কয়েক হাজার বর্গফুটের বেশি এলাকা জুড়ে গেছে। এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগই চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনাবাহিনী আধুনিকায়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছেন। মূল লক্ষ্য— চীনের গণমুক্তি সেনাবাহিনী (পিএলএ) কে ‘বিশ্বমানের বাহিনী’ হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি রকেট বাহিনী (পিএলএআরএফ) এরও সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন, যা এখন দেশের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রগুলো প্রায় সব ধরনের সামরিক শাখায় সরবরাহ করে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনী হিসেবে পিএলএর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা দুই মিলিয়নের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ (পেন্টাগন) অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চীনের রকেট বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেটও ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে— যা টানা চতুর্থ বছর ৭ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির রেকর্ড। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইউক্রেন ও ইসরায়েলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছে, যার ফলে নিজের গোলাবারুদের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জুলাইয়ে সিএনএন জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষায় ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ মজুদ ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানিয়েছে, চীন ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০০টি নতুন পারমাণবিক ওয়ারহেড যোগ করছে, যদিও এখনো মোট সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, চীনের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হলো তাইওয়ান আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়া। এসব ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে চীনের উপকূল থেকে দূরে রাখতে ‘অ্যান্টি-অ্যাকসেস ডিনায়াল বাবল’ তৈরি করবে, যাতে করে আমেরিকা তাইওয়ানের সহায়তায় এগোতে না পারে। বিশ্লেষক ডেকার ইভেলেথ বলেন, ‘চীনের মূল লক্ষ্য হলো তাইওয়ান দখলের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া— বন্দর, সরবরাহ ঘাঁটি ও হেলিকপ্টার বেসে হামলা চালানো, যাতে সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব না হয়।’ রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের পর চীন ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের হার প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলেছে বলে সিএনএনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যেভাবে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, চীন সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। তবে চীনের সেনাবাহিনীর ভেতরে দুর্নীতি ও নেতৃত্বের সংকটও দেখা দিয়েছে। গত দুই বছরে রকেট বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলো দেখিয়ে দেয় যে চীন এখন কেবল সামরিক আধিপত্য নয়, বরং প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছে।


প্রিন্ট

নিউজটি শেয়ার করুন

চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনে ব্যাপক বৃদ্ধি, শুরু হয়েছে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা

আপডেট সময় ০৭:১৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫

চীন ২০২০ সাল থেকে দ্রুতগতিতে ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রগুলো সম্প্রসারণ করছে— যার ফলশ্রুতিতে দেশের সামরিক ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি আমেরিকার সঙ্গে নতুন এক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা করতে চলেছে। সিএনএনের বিশ্লেষণে স্যাটেলাইট চিত্র, মানচিত্র ও সরকারি নথিপত্র যাচাই করে এই তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন বা চীনা সেনাবাহিনীর রকেট বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত ১৩৬টি স্থাপনার মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশে নতুন ধরণের কাজ চলছে। এ সব স্থাপনা—যার মধ্যে কারখানা, গবেষণাগার ও পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে—২০২০ সালের শুরু থেকে ২০২৫ সালের শেষ পর্যন্ত মোট ২১ লাখ বর্গমিটার নতুন ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। উপগ্রহচিত্রে এসব এলাকায় নতুন টাওয়ার, বাঙ্কার, অস্ত্র সংরক্ষণস্থল ও ক্ষেপণাস্ত্রের যন্ত্রাংশও দেখা গেছে। ন্যাটোর সাবেক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের প্রধান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ফোরামের জ্যেষ্ঠ ফেলো উইলিয়াম আলবার জানান, ‘চীন এখন নিজেকে বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। আমরা এক নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার দ্বারপ্রান্তে। চীন ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে এবং দীর্ঘকাল ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েকটি উৎপাদন কেন্দ্র এত দ্রুত গড়ে উঠছে যে আশপাশের গ্রাম ও কৃষিজমি দখল করে নিয়েছে। অনেক স্থাপনা গত পাঁচ বছরে কয়েক হাজার বর্গফুটের বেশি এলাকা জুড়ে গেছে। এসব কেন্দ্রের বেশিরভাগই চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিরক্ষা ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণে। ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সেনাবাহিনী আধুনিকায়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছেন। মূল লক্ষ্য— চীনের গণমুক্তি সেনাবাহিনী (পিএলএ) কে ‘বিশ্বমানের বাহিনী’ হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি রকেট বাহিনী (পিএলএআরএফ) এরও সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন, যা এখন দেশের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। চীনের ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রগুলো প্রায় সব ধরনের সামরিক শাখায় সরবরাহ করে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম সেনাবাহিনী হিসেবে পিএলএর সক্রিয় সদস্য সংখ্যা দুই মিলিয়নের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ (পেন্টাগন) অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে চীনের রকেট বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৫ সালে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেটও ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২৪৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে— যা টানা চতুর্থ বছর ৭ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির রেকর্ড। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ইউক্রেন ও ইসরায়েলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহ করছে, যার ফলে নিজের গোলাবারুদের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জুলাইয়ে সিএনএন জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষায় ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ মজুদ ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে, স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) জানিয়েছে, চীন ২০২৩ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় ১০০টি নতুন পারমাণবিক ওয়ারহেড যোগ করছে, যদিও এখনো মোট সংখ্যায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, চীনের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হলো তাইওয়ান আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়া। এসব ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীকে চীনের উপকূল থেকে দূরে রাখতে ‘অ্যান্টি-অ্যাকসেস ডিনায়াল বাবল’ তৈরি করবে, যাতে করে আমেরিকা তাইওয়ানের সহায়তায় এগোতে না পারে। বিশ্লেষক ডেকার ইভেলেথ বলেন, ‘চীনের মূল লক্ষ্য হলো তাইওয়ান দখলের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া— বন্দর, সরবরাহ ঘাঁটি ও হেলিকপ্টার বেসে হামলা চালানো, যাতে সাহায্য পৌঁছানো সম্ভব না হয়।’ রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধের পর চীন ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের হার প্রায় দ্বিগুণ করে ফেলেছে বলে সিএনএনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া যেভাবে ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করছে, চীন সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। তবে চীনের সেনাবাহিনীর ভেতরে দুর্নীতি ও নেতৃত্বের সংকটও দেখা দিয়েছে। গত দুই বছরে রকেট বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিবর্তনগুলো দেখিয়ে দেয় যে চীন এখন কেবল সামরিক আধিপত্য নয়, বরং প্রযুক্তিগত ও কৌশলগত দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামছে।


প্রিন্ট