২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সামরিক অভিযানের মুখে প্রায় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে কক্সবাজারের মোট ৩৩টি শিবিরে এই সংখ্যাটি প্রায় দশ লাখে পৌঁছেছে, যাদের অর্ধেকেরও বেশি শিশু। দীর্ঘ সময় ধরে শরণার্থী জীবন কাটানোর ফলে তারা এখন বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যের সমস্যা ভুগছে। এর ফলে নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাব, অপুষ্টি, এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে আইসিডিডিআরবি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশু-কিশোরদের জন্য উপযুক্ত স্যানিটেশন সুবিধা উন্নয়নে এক নতুন ও উদ্ভাবনী গবেষণা পদ্ধতি চালু করেছে—ইউজার সেন্টার্ড কমিউনিটি এংগেজমেন্ট বা ইউসিসিই। এই পদ্ধতিটি মূলত অংশগ্রহণমূলক গবেষণার একটি ধারা, যেখানে ব্যবহারকারীদের প্রয়োজন, অভিজ্ঞতা ও মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এই গবেষণার প্রধান গবেষক ডাঃ ফারজানা জাহান বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, যারা প্রতিদিন এই সুবিধাগুলো ব্যবহার করে, তারা-ই তাদের প্রয়োজন ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানে। তাই আমরা তাদের মতামত ও অভিজ্ঞতা ভিত্তি করেই পুরো নকশা তৈরি করেছি।” ইউসিসিই পদ্ধতির শুরু হয় এক জরিপের মাধ্যমে। প্রথমে ৩ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশু ও তাদের মা-বাবাদের কাছ থেকে জানা হয় ক্যাম্পের বিদ্যমান টয়লেটগুলোতে কি কি সমস্যা আছে এবং তারা কেমন ব্যবস্থা চান। এর পরে, একাধিক ‘কো ক্রিয়েশন সেশন’ আয়োজন করা হয়, যেখানে শিশুরা ও তাদের অভিভাবকরা আলাদা আলাদা সেশনে আলোচনা করে জানায়, তারা কেমন টয়লেট ও হাত ধোয়ার স্থান চায়। এই তথ্যের ভিত্তিতে ক্যাম্প ৮ ডব্লিউএবং ১৭-এ মোট ৮০টি শিশু বান্ধব টয়লেট ও হাত ধোয়ার স্থানের পরিকল্পনা ও নির্মাণ করা হয়। টয়লেটের নকশায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। যেমন, ছোট প্যান শিশুদের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হয়, পা রাখার উচ্চতা ও আকৃতি পরিবর্তন করা হয়, ভেতরে দেওয়া হয় ধরে রাখার জন্য হাতল। দরজার তালাও এমনভাবে তৈরি হয় যাতে শিশুরা সহজে খুলতে ও বন্ধ করতে পারে। গরমের সময় ভেতরের পরিবেশ ঠাণ্ডা রাখতে ছাদের উপর বিশেষ তাপ নিরোধক বসানো হয়। প্রতিটি টয়লেটে সংযুক্ত করা হয় একটি হাত ধোয়ার স্থান, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ্যশীল ও শিশুদের উচ্চতার সঙ্গে মানানসই। পানির ট্যাপ এমনভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে শিশুরা সহজে ব্যবহার করতে পারে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ভিইআরসি এর টেকনিক্যাল ফোকাল (হাইজিন) জয় চাকমা বলেন, “এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো, এই জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো নিজেদের আগ্রহে এতে অংশ নিয়েছেন। এর ফলে শুধু কাঠামোই তৈরি হয়নি, বরং সবাই নিজেদের সম্পদ মনে করে সেগুলোর যত্ন নেওয়ার অনুভূতিও জেগে উঠেছে।” ২০১৭ সালে সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করে ভালো ফলাফল পায়। আইসিডিডিআরবি সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদ্ধতিটিকে আরও উন্নত করে গবেষণা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন রূপ দিয়েছে। বর্তমানে এই অংশগ্রহণমূলক গবেষণার পদ্ধতি রোহিঙ্গা সমাজে শুধু শিশুদের স্যানিটেশন সুবিধার উন্নয়নে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সচেতনতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণের সংস্কৃতি গড়ে তুলছে। এই উদ্যোগ মানবিক সংকটের পরিস্থিতিতে জনগোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত উন্নয়ন পদ্ধতির একটি বাস্তব উদাহরণ হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা শিবিরের এই অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—গবেষণা ও উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী সাফল্য তখনই আসে, যখন ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও অংশগ্রহণকে গবেষণার কেন্দ্রে রাখা হয়।