, বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নোটিশ :
সংবাদের বিষয়ে কিছু জানাতে ইমেইল করুন [email protected] ঠিকানায়

বিয়ের প্রথম বছরেই ‘ইচ্ছার বাইরে’ গর্ভবতী ৭৩ শতাংশ নারী

নিউজ ডেস্ক
  • আপডেট সময় ৩ ঘন্টা আগে
  • / ২ বার পড়া হয়েছে

বিবাহের মাধ্যমে নতুন জীবনের সূচনা হলেও বাংলাদেশের অনেক নারীর জন্য সেই জীবন শুরু হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ, চাপ এবং সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে দিয়ে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর-বি) এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পাঁচজনের মধ্যে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন। একই সঙ্গে বিবাহের প্রথম বছরের মধ্যে ৭৩ শতাংশ নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন– যার বেশিরভাগই ছিল, তাদের ইচ্ছার বাইরে বা সময়ের আগে। বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ঢাকায় আইসিডিডিআরবির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল নববিবাহিত দম্পতিদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট ও চাহিদা নিরূপণ’ শীর্ষক এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে পরিচালিত এই দুই বছরের গবেষণাটি বাংলাদেশের নববিবাহিত দম্পতিদের বিবাহের পরবর্তী জীবন নিয়ে প্রথম দীর্ঘমেয়াদী গভীর পর্যবেক্ষণ। গবেষণায় দেখা গেছে, দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই নারীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় ব্যাপক হস্তক্ষেপ শুরু হয়। বিবাহের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে ৭৯ শতাংশ নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলাফেরা, পড়াশোনা, চাকরি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত। গবেষকরা বলছেন, এই নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়। দুই বছরের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী আর্থিক সহিংসতার শিকার হন। পাশাপাশি ২৩ শতাংশ নারী মানসিক, ১৫ শতাংশ শারীরিক এবং ১৪ শতাংশ যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কেবল ৪ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা এই সময়ে কোনো ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হননি। ইচ্ছার বাইরে মাতৃত্বের চাপ গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে দ্রুত ও অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের চিত্রে। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ বিবাহের প্রথম বছরেই গর্ভবতী হন। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ গর্ভধারণ ছিল অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগেই। বিশেষ করে শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসকারী নারীদের মধ্যে এই সমস্যা আরও প্রকট। সেখানে ৬৮ শতাংশ নারী অন্তত দুই বছর সন্তান নেওয়া পিছিয়ে দিতে চাইলেও বাস্তবে ৬৭ শতাংশ নারী সেই সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে যান। গবেষকদের মতে, গর্ভনিরোধক ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সীমিত ক্ষমতা এর প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহের পরপরই নারীদের শিক্ষার ও কর্মজীবনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়। গ্রামে ৬০ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৬ শতাংশ নারী বিবাহের পরে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বাধা, পারিবারিক সিদ্ধান্ত, বাসস্থানের পরিবর্তন, সামাজিক রীতিনীতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীলতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য অন্যরকম নিয়ন্ত্রণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক নারী কাজ করতে আগ্রহী হলেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বাধার কারণে সেই সুযোগ পান না। গবেষকদের মতে, এই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা পরবর্তীতে নারীর উপর সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়। বাল্যবিবাহ এখনো বড় সমস্যা গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূরণের আগে। পুরুষদের মধ্যে কম বয়সে বিবাহের হার উল্লেখযোগ্য— গ্রামে ১৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৭ শতাংশ পুরুষ ২১ বছরের আগেই বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। কম বয়সে বিবাহপ্রাপ্ত নারীদের অনেকের বিয়ে পরিবার থেকেই ঠিক করা হয়েছিল। গ্রামে এই হার ৮৫ শতাংশ এবং শহরে ৫৩ শতাংশ। গবেষকেরা বলছেন, বাল্যবিবাহ নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও প্রধান গবেষক ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা, সহকারী বিজ্ঞানী তারানা-ই-ফেরদৌস এবং রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ। সেমিনারে বক্তারা বলেন, দেশে এখনও বিপুল সংখ্যক বাল্যবিবাহ হচ্ছে, বিশেষ করে প্রান্তিক ও গ্রাম এলাকায়। বাল্যবিবাহ বন্ধ না করলে নারীর শিক্ষা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হবে। তারা আরও বলেন, বিবাহের প্রথম কয়েক বছর নারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়– এই সময়ে সুরক্ষা, সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ না নিলে সহিংসতা ও অনিচ্ছাকৃত মাতৃত্বের এই চক্র ভাঙা কঠিন।


প্রিন্ট
ট্যাগস

নিউজটি শেয়ার করুন

বিয়ের প্রথম বছরেই ‘ইচ্ছার বাইরে’ গর্ভবতী ৭৩ শতাংশ নারী

আপডেট সময় ৩ ঘন্টা আগে

বিবাহের মাধ্যমে নতুন জীবনের সূচনা হলেও বাংলাদেশের অনেক নারীর জন্য সেই জীবন শুরু হচ্ছে নিয়ন্ত্রণ, চাপ এবং সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে দিয়ে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর-বি) এক দীর্ঘমেয়াদী গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই পাঁচজনের মধ্যে চারজন নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হচ্ছেন। একই সঙ্গে বিবাহের প্রথম বছরের মধ্যে ৭৩ শতাংশ নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন– যার বেশিরভাগই ছিল, তাদের ইচ্ছার বাইরে বা সময়ের আগে। বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) ঢাকায় আইসিডিডিআরবির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত গ্রামীণ ও শহরাঞ্চল নববিবাহিত দম্পতিদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট ও চাহিদা নিরূপণ’ শীর্ষক এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার অর্থায়নে পরিচালিত এই দুই বছরের গবেষণাটি বাংলাদেশের নববিবাহিত দম্পতিদের বিবাহের পরবর্তী জীবন নিয়ে প্রথম দীর্ঘমেয়াদী গভীর পর্যবেক্ষণ। গবেষণায় দেখা গেছে, দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই নারীদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় ব্যাপক হস্তক্ষেপ শুরু হয়। বিবাহের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে ৭৯ শতাংশ নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলাফেরা, পড়াশোনা, চাকরি, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত। গবেষকরা বলছেন, এই নিয়ন্ত্রণ ধীরে ধীরে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়। দুই বছরের মধ্যে ৫২ শতাংশ নারী আর্থিক সহিংসতার শিকার হন। পাশাপাশি ২৩ শতাংশ নারী মানসিক, ১৫ শতাংশ শারীরিক এবং ১৪ শতাংশ যৌন সহিংসতার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কেবল ৪ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা এই সময়ে কোনো ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হননি। ইচ্ছার বাইরে মাতৃত্বের চাপ গবেষণার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে দ্রুত ও অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের চিত্রে। মোট অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ বিবাহের প্রথম বছরেই গর্ভবতী হন। এর মধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ গর্ভধারণ ছিল অনিচ্ছাকৃত বা সময়ের আগেই। বিশেষ করে শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসকারী নারীদের মধ্যে এই সমস্যা আরও প্রকট। সেখানে ৬৮ শতাংশ নারী অন্তত দুই বছর সন্তান নেওয়া পিছিয়ে দিতে চাইলেও বাস্তবে ৬৭ শতাংশ নারী সেই সময়ের মধ্যেই গর্ভবতী হয়ে যান। গবেষকদের মতে, গর্ভনিরোধক ব্যবহারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীর সীমিত ক্ষমতা এর প্রধান কারণ। গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহের পরপরই নারীদের শিক্ষার ও কর্মজীবনের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়। গ্রামে ৬০ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৬ শতাংশ নারী বিবাহের পরে পড়াশোনা বন্ধ করে দেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বাধা, পারিবারিক সিদ্ধান্ত, বাসস্থানের পরিবর্তন, সামাজিক রীতিনীতি এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতা এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীলতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের জন্য অন্যরকম নিয়ন্ত্রণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক নারী কাজ করতে আগ্রহী হলেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির বাধার কারণে সেই সুযোগ পান না। গবেষকদের মতে, এই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা পরবর্তীতে নারীর উপর সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়। বাল্যবিবাহ এখনো বড় সমস্যা গবেষণায় অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে গ্রামে ৪৩ শতাংশ এবং শহরের বস্তিতে ৬৫ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর পূরণের আগে। পুরুষদের মধ্যে কম বয়সে বিবাহের হার উল্লেখযোগ্য— গ্রামে ১৫ শতাংশ এবং শহরে ৩৭ শতাংশ পুরুষ ২১ বছরের আগেই বিবাহ সম্পন্ন করেছেন। কম বয়সে বিবাহপ্রাপ্ত নারীদের অনেকের বিয়ে পরিবার থেকেই ঠিক করা হয়েছিল। গ্রামে এই হার ৮৫ শতাংশ এবং শহরে ৫৩ শতাংশ। গবেষকেরা বলছেন, বাল্যবিবাহ নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ও প্রধান গবেষক ড. ফৌজিয়া আখতার হুদা, সহকারী বিজ্ঞানী তারানা-ই-ফেরদৌস এবং রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর সৈয়দ হাসান ইমতিয়াজ। সেমিনারে বক্তারা বলেন, দেশে এখনও বিপুল সংখ্যক বাল্যবিবাহ হচ্ছে, বিশেষ করে প্রান্তিক ও গ্রাম এলাকায়। বাল্যবিবাহ বন্ধ না করলে নারীর শিক্ষা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিত করা কঠিন হবে। তারা আরও বলেন, বিবাহের প্রথম কয়েক বছর নারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়– এই সময়ে সুরক্ষা, সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ না নিলে সহিংসতা ও অনিচ্ছাকৃত মাতৃত্বের এই চক্র ভাঙা কঠিন।


প্রিন্ট